নিরাপদ সড়ক বাস চলছে চুক্তিতে রেষারেষি থামেনি

বাসের রেষারেষি। গতকাল দুপুরে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায়। প্রথম আলো
ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগ কারণ চুক্তিতে বাস চালানোচুক্তিতে চললে চালকদের বেশি বেশি ট্রিপের তাড়া থাকে
খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও তাঁর সহকারী আয় তোলেন
ফলে বেশি যাত্রী ও ট্রিপের জন্য চালকেরা বেপরোয়া থাকেন

রাজধানীতে বেপরোয়া বাস চালানো ও রেষারেষি বন্ধে আড়াই মাস আগে পরিবহন মালিক সমিতি চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ফলে নির্ধারিত বেতন না থাকায় বেশি যাত্রী ও ট্রিপের জন্য এখনো বেপরোয়া বাস চলাচল করছে। এতে বাসের চাপায় প্রাণহানিও বন্ধ হচ্ছে না।গতকাল সোমবার নিরাপদ সড়ক দিবসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে দুজন নিহত হন। তাঁরা হলেন মো. সেলিম (২২) ও মো. জুয়েল (৩০)। পুলিশ জানিয়েছে, দুটি বাসই ছিল ট্রান্স সিলভা কোম্পানির। বাস দুটি জব্দ করা হয়েছে। একজন চালককে আটক করা হয়েছে। তাঁর কাছে বাস চালানোর লাইসেন্স ছিল না। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীতেই বিকেলে বাসের ধাক্কায় পথচারী মোর্শেদা বেগম (৫০) মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর নাতনিও আহত হন।

পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগ কারণ চুক্তিতে বাস চালানো। চুক্তিতে চললে চালকদের বেশি বেশি ট্রিপের (এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত) তাড়া থাকে। জমার টাকা, সড়কে বিভিন্ন চাঁদা, জ্বালানি খরচ এবং অন্যান্য খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও তাঁর সহকারী নিজের আয় তোলেন। ফলে বেশি যাত্রী এবং ট্রিপের জন্য চালকেরা বেপরোয়া থাকেন। একই পথের অন্য পরিবহনের সঙ্গে বেশি রেষারেষি করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবহনের দুই বাসেও যাত্রী তোলা নিয়ে রেষারেষি হয়।

গত ২৯ জুলাই বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবহন মালিক সমিতি ঘোষণা দেয়, ৯ আগস্ট থেকে চুক্তিতে গাড়ি চালানো হবে না। কোনো মালিক চালকের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি চালালে ওই কোম্পানির সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা হবে।

গতকাল গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ পথে চলাচলকারী বলাকা, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে কালশী হয়ে গাবতলী চলাচলকারী রাজধানী সুপার, যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে মিরপুর আনসার ক্যাম্প চলাচলকারী আকিক, মোহাম্মদপুর থেকে আবদুল্লাহপুর পথে চলাচলকারী তেঁতুলিয়া এবং পরিস্থান পরিবহন, মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে মতিঝিলগামী নিউ ভিশন, মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে সদরঘাটগামী তানজিল পরিবহন, মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে আজিমপুরগামী মিরপুর লিংকসহ বিভিন্ন পথে চলাচলকারী অন্তত ২০টি বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

এসব বাসের চালক ও সহকারীরা জানান, তাঁদের কারও বেতন নির্ধারিত নয়। মালিক সমিতির নির্দেশে বেতনভিত্তিক গাড়ি চলছে না। কোনো বাসের ক্ষেত্রে প্রতি ট্রিপ অনুযায়ী চালক ও সহকারীরা টাকা পান। আবার কোনো ক্ষেত্রে সারা দিনের জন্য নির্দিষ্ট জমার চুক্তিতে মালিকেরা চালককে বাস চালাতে দেন।

গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পথে চলাচলকারী রাজধানী সুপার পরিবহনের চালক বলেন, ‘প্রতি ট্রিপে ২৫০ টাকা পাই। প্রায় একই পথে অন্য কোম্পানির বাস আছে। তাই যাত্রী তুলতে হলে একটু তাড়াহুড়া করাই লাগে। আবার ট্রিপ কম দিলে নিজের আয় কমে, তাই একটু জোরেও চালানো লাগে।’

তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার ৮০ শতাংশ বাস এখন চুক্তিতে চলে না। কোনো চালক পুরো মাস একই মালিকের বাস চালান না। তাই মাসিক বেতন নির্ধারণ কঠিন। ট্রিপ ভিত্তিতে দৈনিক একটি মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বেপরোয়া চালানো অনেকটাই কমছে।

মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে আবদুল্লাহপুরগামী সব বাস যাত্রী তোলে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর ফায়ার সার্ভিসের সামনে থেকে। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রজাপতি, তেঁতুলিয়া, বসুমতী পরিবহনের তিনটি বাস আড়াআড়ি রাখা। চালকের সহকারীরা যাত্রী তোলার জন্য হাঁকডাক করছেন। পেছনে পরিস্থান পরিবহনের আরেকটি বাস এসে প্রজাপতি পরিবহনের বাসটিকে ধাক্কা দিচ্ছে। অথচ বাসগুলো এই মোড়ে থামারই কথা নয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নির্ধারণ করে দেওয়া বাস থামানোর জায়গাটি আরও অন্তত ৫০ ফুট দূরে।

পরিস্থান পরিবহনের চালক মো. ইয়াসিন বলেন, ‘গার্মেন্টসের শ্রমিকদের বেতন সরকার ঠিক করে দেয়। বাস ড্রাইভার, হেলপারদের বেতন বা দৈনিক মজুরি সরকার ঠিক করে দিক। তাহলে মালিকেরা তাড়া দিতে পারবে না। ড্রাইভাররাও যাত্রী তোলার জন্য পাল্লা দেবে না।’

কোনো মালিক চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি চালাচ্ছেন কি না, তা দেখতে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ঢাকার একাধিক জায়গায় পরিদর্শক দল বসিয়েছিল মালিক সমিতি। বেশ ঘটা করে এসব পরিদর্শক দলের অভিযান শুরু হয়েছিল, এখন তা থেমে গেছে। চুক্তিতে গাড়ি চালানোর অপরাধে ৯ আগস্ট পাঁচটি পরিবহন কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করেছিল মালিক সমিতি। তবে সমিতির সদস্যপদ হারালেও এসব পরিবহনের বাসের নিবন্ধন বাতিল হয়নি। ফলে এসব বাস প্রতিদিনই চলছে।

জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, নেতারা বলছেন এক কথা, বাস্তবে হচ্ছে আরেক। মালিক সমিতির নেতাদের কথা তাঁদের সমিতির সদস্যরাই মানছেন না। চালক ও সহকারীর বেতন নির্ধারণের পাশাপাশি মালিকের জমাও নিশ্চিত করার বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মালিক সমিতি, বাসমালিক, সরকারি সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বসে মাসিক বেতন বা দৈনিক মজুরি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
নিরাপদ সড়ক বাস চলছে চুক্তিতে রেষারেষি থামেনি নিরাপদ সড়ক বাস চলছে চুক্তিতে রেষারেষি থামেনি Reviewed by getideaa2z on 3:14 AM Rating: 5

No comments:

Theme images by chuwy. Powered by Blogger.